Tuesday, 31 March 2020

COVID

এই লকডাউনে যে ১০টি বিষয় চিরতরে বদলে গেল

corona
জনসাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে খাবার। ছবি: পিটিআই
ব্যক্তিই হোক বা সমাজ, প্রতিটি সঙ্কট আমাদের বদলে দেয়। কোভিড-১৯-এর অতিমারিও অবশ্যই তা করবে। তবে কতটা বদল আনবে এই সঙ্কট, তা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্তরে লকডাউন এই বদলের বেশ কিছু ইঙ্গিত আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এখানে তেমনই ১০টি এলোমেলো ভাবনা তুলে ধরলাম।   
১) করোনা-অভিজ্ঞতা আমাদের পূজা-প্রার্থনার ধরনকে বদলে দিচ্ছে। প্রতি রবিবার সকালে আমাকে অবধারিত ভাবে যেখানে পাওয়া যায়, সেটা চার্চ। কিন্তু গত দুটো রবিবার আমি সেখানে যেতে পারিনি। ভারতের সমস্ত বিশপই এই পরিস্থিতিতে চার্চে যেতে নিষেধ করেছেন। আমি বাড়িতেই প্রার্থনা সেরে নিচ্ছি। বাড়িকেই চার্চ বানিয়ে নিচ্ছি। খ্রিস্ট ধর্মে এই সময়টা ‘পিরিয়ড অফ লেন্ট’, ইস্টার সানডে পর্যন্ত এটা চলে। যে কোনও খ্রিস্টানের কাছে এই সময়ের ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম। এই বছর আমি এই সংক্রান্ত সম্মিলনের বাইরে।  
এই একাকিত্ব আমার একার নয়। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ— যাবতীয় সম্প্রদায়ের কাছে এটা এখন বাস্তব। তা হলে কি উপাসনা ব্যক্তিগত স্তরে চলে গেল এই অবসরে?
২) এই সুযোগে আমাদের মধ্যে অনেকেই সিরিয়াস সাংবাদিকতাকে চিনতে শিখলাম। টেলিভিশন স্টুডিওর ঠান্ডা ঘরে অথবা আরামপ্রদ ড্রয়িং রুমে ক্যামেরার সামনে বসে অথবা টুইট করে সাংবাদিকবৃত্তি যে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্করহিত, এ কথা আমরা টের পেলাম। রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কাজ করলেন যে সব সাংবাদিক, তাঁদের সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধা বাড়ল। সাড়ম্বর পণ্ডিতি আমাদের খানিক কম হলেও চলত। দিল্লির সীমান্তে দাঁড়িয়ে সেখানকার অস্থির ছবিগুলিকে যাঁরা সযত্নে তুলে ধরলেন, যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলির সঙ্গে মাইলের পর মাইল হাঁটলেন, তাঁদের দুর্দশাকেতুলে ধরলেন, আমরা সেই অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের কুর্নিশ জানাই। 
৩) স্বাস্থ্য কর্মী এবং চিকিৎসকদের আমরা কী চোখে দেখে থাকি? স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হাসপাতালের লম্বা লাইন আর চিকিৎসার খরচ নিয়ে আমরা সমালোচনায় মুখর থাকি। আজ স্বাস্থ্য কর্মীদের আমরা এই যুদ্ধের সম্মুখবর্তী সেনা হিসেবে দেখছি। হ্যাঁ, ইতিপূর্বে চিকিৎসকদের উপরে হিংসাত্মক আক্রমণ ঘটেছে, কিন্তু আজ সেই চিকিৎসক ও নার্সরাই আমাদের প্রিয়জন। এই পরিস্থিতি কেটে গেলে এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
৪) আমরা জনস্বাস্থ্য খাতে কত খরচ করি? যদি ভেন্টিলেটরের কথাই ধরেন, তবে ১৩০ কোটির দেশে মাত্র ৪০ হাজার ভেন্টিলেটর রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮,৫০০টি রয়েছে সরকারি হাসপাতালে। বাকি বেসরকারি হাসপাতালে। এ ভাবে কিছু সামলানো যায় না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই মুহূর্তে নজর কাড়ছেন। তাঁদের পরামর্শে আমরা কান দিতে শুরু করেছি, তাঁদের সাবধানবাণীতে আস্থা রাখতে শুরু করেছি। হেলথ বিটের সাংবাদিকরা আমাকে জানিয়েছেন, তাঁদের প্রতি মানুষ আরও বেশি সিরিয়াস হচ্ছেন।
লকডাউনের সময় বাড়িতে চলছে যোগাভ্যাস।
৫) ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীরা এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। দলমত-নির্বিশেষে তাঁরা কাজ করে চলেছেন। বাংলা, কেরল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং পঞ্জাবের সরকার লকডাউন চ্যালেঞ্জের মধ্যে দারুণ কাজ করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮টি রাজ্য সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন রেখেছেন।
৬) জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কেও আমাদের ধারণা বলেছে। উদাহরণ দিতে বসলে প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসে, তিনি একজন মুখ্যমন্ত্রী। স্থানীয় বাজারে পায়ে হেঁটে ঘুরছেন, মানুষকে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বোঝাতে চক দিয়ে রাস্তায় গোল দাগ টেনে বোঝাচ্ছেন কতটা দূরত্বে দাঁড়ানো নিরাপদ। নিঃসন্দেহে এটা জনসংযোগের একটা জোরালো জায়গা।
৭) লকডাউন পরিস্থিতিতে আমাদের পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় হল। একটা ফ্ল্যাটে চার থেকে পাঁচ জন আটকে রয়েছেন, দিনে একাধিক বার পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন— এই ছবি এখন প্রায় সব পরিবারেই। বাচ্চারা অনলাইনে ক্লাস করছে, বাবা-মা ওয়ার্ক ফ্রম হোম। দুপুরে খাওয়ার সময়ে একত্র হচ্ছেন। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় ঠিকই, কিন্তু এর সদর্থক দিক তো রয়েছেই। যখন পারছেন, পরিবারের সদস্যরা বোর্ড গেম খেলছেন। খাবারের যোগান নিয়ে যাঁদের ভাবতে হচ্ছে না, তাঁদের কাছে এই ঘরবন্দিত্ব এক রকম আনন্দেরই বলা যায়। লকডাউন শেষ হলে এই বন্ধনের রেশ থেকে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
৮) পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিবহাল করল এই লকডাউন। ২০১১-এর জনগণনা অনুসারে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ অর্থাৎ ৪৫ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ অভ্যন্তরীণ পরিযায়ী শ্রমিক। এর মধ্যে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৫ কোটি মানুষ কাজের সন্ধানে অন্যত্র যেতে বাধ্য হন। এর মধ্যে  তিন কোটি পুরুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। দু’কোটি পরিযায়ী আসেন দু’টি রাজ্য—উত্তর প্রদেশ এবং বিহার থেকে। দশ কোটি শ্রমিক শুধুমাত্র দু’টি শহরে আশ্রয় খোঁজে—দিল্লি এবং মুম্বই।  
পরিযায়ী শ্রমিকরা হঠাৎই কাজ হারালেন, কোনও ভাবে বাড়ি ফিরতে চাইলেন। এমনকি, বাড়ি ফেরার তাগিদে মাইলের পর মাইল হাঁটলেন—এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমাদের সামাজিক বিবেকের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এই শ্রমিকেরা আমাদের সম্পদ। এঁরা না থাকলে আমাদের অর্থনীতি দুমড়ে পড়বে। এই সঙ্কট তাদের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাক। প্রতিটি রাজ্যেরই তাদের কাছে বিপুল ঋণ, এটা বুঝিয়ে দিক।
তৈরি হচ্ছে খাবার।
৯) কোভিড-১৯ অতিমারী এবং লকডাউনের কালে দান-দাক্ষিণ্য আর ‘ভাল কাজ’ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাও বদলে গেল। দান মানে যে কোনও যুক্তিসম্মত অথচ দূরবর্তী কোনও কারণে চেক সই করা, এই ধারণা ধাক্কা খেল। দাক্ষিণ্য মানে এখন নিজের নিকটবর্তী বস্তিতে গিয়ে দিনমজুরদের জন্য খাবারের যোগান। পাড়ার মুদির দোকান থেকেই জিনিস কেনা, যাতে সেই ছোট দোকানদারটিও তার ব্যবসা এই দুর্দিনেও চালিয়ে যেতে পারে, তার খেয়াল রাখা। ব্যাপারটা তেমন কঠিন নয়, লকডাউন আমাদের বোঝাতে পেরেছে।
১০) ‘প্রাইভেসি’-র ধারণারও বদল ঘটাল এই লকডাউন। হোম কোয়রান্টিনদের ট্র্যাক করতে মোবাইল ফোনের সিগন্যালকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তিন মাস আগেও এমন ঘটলে প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে— বলে বিতর্ক দেখা দিত। আজ এটাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই মেনে নিতে হয়েছে। দিল্লির ৭২২ জন বাসিন্দা, যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরেছেন, তাঁদের ফোন নম্বর, ঠিকানা এবং পাসপোর্টের ডিটেল হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে। এই তালিকায় একটি এক বছর বয়সি শিশুও রয়েছে। সঙ্কটের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে আমরা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছি না। প্রাইভেসির এই ঘেঁটে যাওয়ায় কতটা লাভ আর কতখানি ক্ষতি হল, সে হিসেব সঙ্কট কাটলে দেখা যাবে।  

No comments:

Post a Comment